ডেস্ক নিউজ:

মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী (ফাইল ছবি)মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতনের কারণে এ বছরের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তখন থেকেই তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করে বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে শুরু হয় দর কষাকষি।

দীর্ঘ দর কষাকষির পর গত ২৩ নভেম্বর দুই দেশ একটি চুক্তিস্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে প্রায় সাত লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার জন্য চুক্তি করলো মিয়ানমার। কিন্তু যেসব বিষয় বাংলাদেশ বিশেষভাবে চেয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগই এতে নেই। ফলে মিয়ানমারের দাবির প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে এখানে।

রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ কী চায় তা গত ১০ অক্টোবর ঢাকায় এক সেমিনারে বর্ণনা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সব নাগরিককে ফিরিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছি। যাচাই প্রক্রিয়ায় যোগ্য বিবেচিত সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসার তারিখ বিবেচনা না করে ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি মিয়ানমারকে। ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের যোগ্যতা নির্ধারণে মিয়ানমারের নিজস্ব যাচাইয়ের প্রস্তাবের বিপরীতে বাংলাদেশ যৌথ যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।’

প্রস্তাবিত দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থার খসড়ায় ফেরত পাঠানোর সব পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অংশীদার ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির নীতি ও শর্ত অনুযায়ী একটি যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয় মিয়ানমার। আমরা ১৯৯২ সালের সঙ্গে বর্তমান সমস্যার মাত্রা ও প্রকৃতির ভিন্নতার বিষয়টি তুলে ধরি। বাস্তবতার কারণে ১৯৯২ সালের নীতি ও শর্ত পুনর্বিবেচনা আর নতুন কাঠামো ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করি।’

এছাড়া সময় নির্দিষ্টকরণ চুক্তির বিষয়ে জোর দিয়েছিল বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা যেন রাখাইনে নিজস্ব আবাসস্থলে ফিরে যেতে পারে তা এ বছরের অক্টোবরের প্রাথমিক খসড়ায় ছিল।

এর বিপরীতে শনিবার (২৫ নভেম্বর) চুক্তিস্বাক্ষরের পর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করতে চায় মিয়ানমার। সেভাবেই জিনিসটি সাজানো হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, এটা নাই সেটা নাই বলে তো লাভ নেই।’

সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া প্রসঙ্গে মন্ত্রী শনিবার (২৫ নভেম্বর) বলেন, ‘স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও এ বছরের ২৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফেরত নেবে মিয়ানমার।’

সময়সীমা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ফিরিয়ে নেওয়ার কোনও টাইমফ্রেম দেওয়া যায় না। প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার হলো, এ ধরনের টাইমফ্রেম দিয়ে কোনও লাভও নেই।’

যৌথ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রী বলেন, ‘একটি যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনও জটিলতা দেখা দিলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবে।’

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তার বিষয়ে এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, ‘মিয়ানমার প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত সময়ে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে প্রক্রিয়ায় যুক্ত করবে।’

রাখাইনে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুরনো আবাসস্থল বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাছাকাছি কোনও স্থানে পুনর্বাসিত করা হবে।’

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দলে দলে প্রথমবার পালিয়ে আসে ১৯৭৮ সালে। তখন তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তিস্বাক্ষর হয়। এর অধীনে ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে গিয়েছিল।

১৯৯২ সালে আবার দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ওই সময় তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আরেকটি সমঝোতা হয়। এর অধীনে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে যায় মিয়ানমারে।

২০১২ সালে রাখাইনে জাতিগত দাঙ্গা এবং ২০১৬’র অক্টোবর ও গত আগস্টে মিয়ানমারের পুলিশ ক্যাম্পে ‘হামলা’র ঘটনার জের ধরে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে।